Pondicherry & Mahabalipuram
আমরা পন্ডিচেরী বেড়াতে যাবো ঠিক করলাম ২০১৯ এর ৩০ অগাস্ট। গুগল ম্যাপ এ দেখলাম বেঙ্গালুরু থেকে পন্ডিচেরী প্রায় ৩৫০-৩৭০ কিলোমিটার এবং পন্ডিচেরি যাওয়ার অনেকগুলো রাস্তা আছে। ইন্টারনেট ঘেটে দেখলাম বেঙ্গালুরু থেকে কৃষ্ণগিরি, কৃষ্ণগিরি থেকে ভেল্লোর (AH ৪৫), ভেল্লোর থেকে ত্রিবান্দম হয়ে পন্ডিচেরী। এই রুটটা লম্বা কিন্তু রাস্তা খুব ভালো। আপনারা ট্রেন বা ফ্লাইট এ গেলে চেন্নাই হয়ে সেখান থেকে পন্ডিচেরী যেতে পারেন। পন্ডিচেরী শীতকাল এ যাওয়ার চেষ্টা করবেন কারণ এখানে খুব গরম আর আর্দ্রতা থাকে ।
আগেরদিন ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রেখেছিলাম, সেই মতো সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ালাম বাইকে ব্যাগ বেঁধে, আর পথ দেখানোর জন্যে গুগল ম্যাপ এ ভরসা। বেঙ্গালুরু ছেড়ে বেরোনোর পরে হাইওয়ে তে বাইক কিছুটা স্পিড এই চালালাম। ব্যাগ এ খাবার ছিল, পথেই প্রাতরাশ সারা হলো, তারপর আবার এগিয়ে চলা, রাস্তা যেন শেষই হয় না। মাঝে বেশ কিছু জায়গায় একটু একটু করে জিরিয়ে নেওয়া ,অবশেষে আমরা পন্ডিচেরি পৌছালাম প্রায় ৩ টা নাগাদ।
হোটেল এ ব্যাগপত্র রেখে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোলাম। অবশ্যই এতোটা রাস্তা বাইক চালিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু সমুদ্র দেখার উৎসাহে সে ক্লান্তি উবে গেলো। প্রথমে আমরা গেলাম কাছের একটা বিচ এ, নাম Pillayarkuppam Big Beach. এই বিচ টি বেশ নির্জন।. শুধু সারি সারি মাছ ধরার ট্রলার , জেলেরা জাল এর জট ছাড়াচ্ছে, আর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে নির্জন সমুদ্র সৈকত এ । আমরা সমুদ্র সৈকত এ বেশ কিছুক্ষন হাটলাম। তার পর বসে সন্ধে হওয়া দেখলাম, আর কিছু ছবি তুললাম।
Pillayarkuppam Big Beach |
এরপর সন্ধে তে ফিরে কাছের একটা রেস্তোরাঁ তে খাওয়া দাওয়া করলাম। চিংড়ি ও মাছের কয়েকরকম পদ দিয়ে রাতের খাওয়া একেবারেই সেরে নিলাম। তার পর হোটেল এ ফিরে পরেরদিন কিভাবে ঘোরা হবে সেই প্ল্যান করে ঘুমিয়ে গেলাম। আমাদের পরের দিনের হোটেল বুক করা ছিলনা।
একটা ভালো রুম দেখে বুক করে নিলাম ঘুমানোর আগে ।
এবার পরের দিন সকালে গেলাম পন্ডিচেরীর সবচেয়ে সুন্দর বিচ প্যারাডিসে বিচ এ। আমরা এই বিচ এ বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম । এখানে একটি খাঁড়ি এসে মিশেছে সমুদ্রে । একটা backwater রয়েছে , যেখানে নৌকাভ্রমণও করা যায় । নিচে প্যারাডিসে বিচ এর কিছু ছবি দিলাম।
এরপর প্যারাডিসে বিচ থেকে ফিরে একটা রেস্টুরেন্ট এ ব্রেকফাস্ট করলাম । তারপর হোটেল এ ফিরে স্নান সেরে পরের হোটেল এ যাওয়ার জন্যে তৈরী হলাম । কিন্তু চেক আউট করে পরের হোটেল এ যাওয়ার সময় দেখলাম যে আমি ভুল তারিখের হোটেল বুক করে রেখেছি । আর অনেক চেষ্টা করেও কোনো হোটেল পেলাম না। সুতরাং একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে বেরোলাম। তারপর বাইক নিয়েই ঘুরলাম ফ্রেঞ্চ কলোনি, রক বিচ, ওয়ার মেমোরিয়াল, প্রমোনাডে বিচ। নিচে কিছু ছবি দিলাম নিচে । দিনের বেলা মেঘলা আবহাওয়ার জন্যে ছবি ভালো আসেনি।
তারপর একটা রেস্তোরাতে দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমরা রওনা দিলাম অরোভিলের উদ্দেশ্যে।
অরোভিল হলো ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের বিলুপুরম জেলার একটি জনপদ। এর কিছু অংশ পন্ডিচেরীর মধ্যে পড়ে । এটি 1968 সালে মীরা আলফাসা ("মা" হিসাবে পরিচিত) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং স্থপতি রজার অ্যাঞ্জার ডিজাইন করেছিলেন। মীরা আলফাসার উক্তি অনুযায়ী ,অরোভিল হলো একটি সর্বজনীন শহর, যেখানে সমস্ত দেশের পুরুষ এবং মহিলা সকল ধর্ম, সমস্ত রাজনীতি এবং সমস্ত জাতীয়তার ঊর্দ্ধে শান্তি এবং প্রগতিশীল সম্প্রীতিতে বাস করতে সক্ষম হন। অরোভিলের উদ্দেশ্য হ'ল মানবিক একতা কে উপলব্ধি করানো ।
অরোভিল এর কেন্দ্রে একটি মাতৃমন্দির রয়েছে এখানে উপাসনা করা হয় । অনুমতিসাপেক্ষে বিশেষ ব্যাক্তি ও অরভিল এর বাসিন্দারা এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন। এখানে অরভিল সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্যে এখানে প্রথমে একটি চলচিত্র দেখানো হয়। আমরা এটি দেখে তারপর পায়ে হেটে অরোভিলে এর মাতৃমন্দির এর উদ্দেশে রওনা দিলাম , এখানে একটি এটি প্রাচীন বট বৃক্ষ রয়েছে যার নিচে অনেকেই ধ্যান করেন। অরভিল হল বাইরের কোলাহল পূর্ণ সমাজ থেকে কিয়ৎ বিচ্ছিন্ন একটা শান্তিপূর্ণ আলাদা জগৎ।
এরপর আমাদের ফেরার পালা, কিন্তু আগে থেকে হোটেল ও বুক নেই । রাত্রে কোথায় থাকবো কোনো ঠিক ছিল না । আমরা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের সাধ্যের মধ্যে কোনো হোটেল পেলাম না পন্ডিচেরী তে। আমরা অনলাইনে একটা হোটেল পেলাম মহাবালিপুরাম এ, এটি প্রায় ১০০ কি.মি. দূরে পন্ডিচেরী থেকে। সারাদিনের ক্লন্তি নিয়ে, রাতের অন্ধকারে সুনসান ইস্ট কোস্ট হাইওয়ে দিয়ে ওই ১০০ কিলোমিটার, একটা ছোট ইঞ্জিন এর বাইকে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা ছিল। আমি বাইক খুব ধীরে চালিয়েছিলাম এবং মাঝে বেশ কয়েকবার বিরতি নিয়েছিলাম। আমাদের মহাবালীপুরোম পৌঁছাতে প্রায় রাত ৯ টা বাজলো। হোটেল এ ঢুকে ফ্রেশ হয়ে রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে একেবারে ঘুম দিলাম।
সকালে উঠে প্রাতরাশ করে আমরা মহাবলীপুরম এর দর্শনীয় স্থান গুলো দেখার জন্যে বের হলাম।
মহাবলীপুরাম প্রধানত সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে পল্লব রাজবংশ এর রাজা নরসিংহবর্মন দ্বারা নির্মিত মন্দির এবং স্মৃতিস্তম্ভগুলির জন্য পরিচিত । প্রথমে আমরা দেখলাম সমুদ্রের এর পাশে অবস্থিত মন্দির (Shore Temple ), তারপর একে একে পঞ্চরথ, টাওয়ার হাউস , বরাহ কেভ , অর্জুন কেভ, কৃষ্ণের মাখন বল। মনে রাখবেন প্রতিটি জায়গায় টিকিট কাউন্টার আছে, ভাষাগত সমস্যার জন্যে বেশির ভাগ লোকই সব জায়গা থেকে টিকিট কেনে। কিন্তু যেকোনো এক জায়গা থেকে টিকিট নিলে ওই টিকিট সব জায়গায় দেখার জন্যে হয়ে যাবে।
এরপর হোটেল এ ফিরে স্নান সেরে আমরা রওনা দিলাম বেঙ্গালুরু এর উদ্দেশ্যে। ফেরার সময় ঠিক করলাম চেন্নাই হয়ে বেঙ্গালোর ফিরবো আর এতটা পথ একটানা যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে না তাই মাঝে কোথাও একরাত কাটিয়ে নেবো। ইস্ট কোস্ট হাইওয়ে ধরে চেন্নাই যাওয়ার পথে পরে কোভালাম বিচ। সেখানে ও একজায়গায় বাইক পার্ক করে কিছুটা সময় কাটানো হলো। কোভালাম বিচ হলো লাল বালির বিচ আর মাঝে মাঝে কিছু পাথর বা বোল্ডার রয়েছে, যেখানে ঢেউ এসে আছড়ে পরে খুব সুন্দর দৃশ্য তৈরী করছে ।
কোভালাম বিচ |
এরপর আবার বাইক চালানো শুরু। মাঝে ভেল্লোর এর কাছাকাছি একটি হোটেলে রাত্রিবাস করে পরের দিন আবার ব্রেকফাস্ট করে বেরোলাম। এবারে গন্তব্য সোজা বেঙ্গালুরু , মাঝে যতটা কম বিশ্রাম নিয়ে ৪-৫ ঘন্টার মধ্যে বেঙ্গালুরু ফিরলাম ।
Comments
Post a Comment